Friday, November 25, 2016

Monday, November 14, 2016

নিকোটিনে শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস
ধূমপানের নানা অপকারিতা সম্পর্কে জানেন মোটামুটি সকল ধূমপায়ী। তারপরও ধূমপান ত্যাগ করতে দেখা যায় অনেক কমসংখ্যক ধূমপায়ীকে। ধূমপান থেকে ফুসফুসের ক্যান্সার, হার্টের রক্তনালী সরু হয়ে হার্ট এ্যাটাকের মত বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটতে পারে। কমে যায় গড় আয়ু, কর্ম ক্ষমতা তার পরও ধূমপায়ীদের তেমন কোন উদ্বেগ নেই। অনেকের ধারনা বহু বছর ধরে ধূমপান করছি, দাদা ধূমপায়ী ছিলেন, বাবা ধূমপায়ী ছিলেন কোন সমস্যা তো দেখিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বিপদ যাদের আসে তারাই বোঝেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে ধূমপানের বড় বড় ক্ষতি বেশী চোখে পড়ে। কিন্তু অনেক ক্ষতি আছে যা চোখে পড়ে না। অথচ ধূমপানের ফলে শতকরা ৫ থেকে ১০ ভাগ ধূমপায়ীর শারীরিক ক্ষমতা বা যৌন ক্ষমতা হ্রাস পায়। আর এই শারীরিক ক্ষমতা হ্রাসের প্রধান শত্রু হচ্ছে সিগারেট, বিড়ি, তামাক, জদ্র্দার মধ্যে থাকা বিষ নামের মারাত্মক ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নিকোটিন। নিকোটিন শুধু রক্তনালী সরু করে দেয় এবং হার্টের রক্তনালীতে চবিê জমতে সাহায্য করে তাই নয়, এই নিকোটিন রক্তের স্বাভাবিক প্রবাহকে কমিয়ে দেয়। ফলে অঙ্গ-প্রতঙ্গের রক্ত চলাচল বাধাগ্র- হয়। এতে শারীরিক ক্ষমতা হ্রাস পায়, পাশাপাশি নিকোটিন ফুসফুস ও হার্টের স্বাভাবিক ক্ষমতাকেও হ্রাস করে। ফলে শারীরিক দুর্বলতা প্রতীয়মান হয় নানা ক্ষেত্রে। সিগারেটের নিকোটিন সাময়িক ভাবে মস্তিস্ক উজ্জীবীত করলেও মস্তিস্ক নিকোটিনের দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতি নানাবিধ। নিকোটিন মস্তিস্কের রক্তনালীকে সরু করে দেয় ফলে মস্তিস্কে রক্তচলাচলেও ব্যহত হয়। মস্তিস্ক হয়ে পড়ে দুর্বল। ফলে বিশেষ ক্ষেত্রে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অধিক রক্ত প্রবাহের প্রয়োজন হলে মস্তিস্ক হার্টকে প্রয়োজনীয় সিগনাল বিলম্ব ঘটায়। ফলে কাংখিত শারীরিক শক্তি অনেক ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। তাই কর্মক্ষম, সক্ষম থাকতে আজই ধূমপান ত্যাগ করুন, সুন্দর দাম্পত্য জীবন গড়ে তুলুন।
*************************
ডাঃ মোড়ল নজরুল ইসলাম
চর্ম, এলার্জি ও যৌনসমস্যা বিশেষজ্ঞ
দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ ফেবুয়ারি ২০১০।
বাংলাদেশে কিডনি সংযোজন পরিস্থিতি
একজন মানুষের কিডনি অন্য একজন অকেজো কিডনির রোগীর দেহে সংযোজন করাকে কিডনি সংযোজন বলা হয়। কিডনি সংযোজন সাধারণত দুই ভাবে করা যায়: মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন এবং নিকটাত্মীয়ের যেকোনো একটি কিডনি নিয়ে সংযোজন। আমাদের দেশে বর্তমানে জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন বা লাইফ রিলেটেড কিডনি প্রতিস্থাপন নিয়মিত হচ্ছে এবং এর সাফল্যও উন্নত বিশ্বের যেকোনো দেশের সমান।

কিডনি সংযোজনের জন্য প্রস্তুতিকোনো রোগীর দুটো কিডনি সম্পূর্ণরূপে অকেজো হয়ে গেলে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রথম প্রয়োজন হয় ডায়ালাইসিসের। রোগীর উপসর্গের ইতিহাস, রক্তের ক্রিয়েটিনিন, ইউরিয়া, ইলেকট্রোলাইট, সনোগ্রাম করে কিডনির অবস্থান ও আকার দেখা, এফজিআর বা সিআর ইত্যাদি পরীক্ষা করে কিডনি অকেজো রোগ নির্ণয় করা হয়। কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো জানার পরই ডায়ালাইসিস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সাধারণত দুই ধরনের ডায়ালাইসিসের প্রচলন আছে—পেরিটোনিয়েল ডায়ালাইসিস ও হেমোডায়ালাইসিস।

তবে হেমোডায়ালাইসিস শুরু করার আগে সাধারণত বাঁ হাতের কবজির ওপর একটি এভি ফিস্টুলা করে নেওয়া হয়, যা সমন্বয় হতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। হেমোডায়ালাইসিসে যন্ত্রের পাশাপাশি রোগীকে ও তাঁর নিকট-পরিজনকে রোগ সম্পর্কে ধারণা, চিকিৎসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, সুযোগ-সুবিধা ও আর্থিক দিক সম্পর্কেও সম্যক ধারণা দেওয়া হয়। এর পরই একজন রোগীর সব দিক বিবেচনা করে কিডনি সংযোজন কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

মরণোত্তর কিডনি সংযোজন
মৃতপ্রায় ব্যক্তির কিডনি নিয়ে অন্য রোগীকে সংযোজন করা খুবই দুঃসাধ্য ব্যাপার। বর্তমান উন্নত বিশ্বে, যেমন: ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে এর সুব্যবস্থা রয়েছে এবং ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কিডনি সংযোজন মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে করা হয়ে থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ‘অল ইন্ডিয়া মেডিকেল ইনস্টিটিউট’ এবং পাকিস্তানের এসআইইউটি (সিন্ধু ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজি ও ট্রান্সপ্লান্টেশন)-এ সম্প্রতি ক্যাডাভারিক বা মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন শুরু হয়েছে। বাংলাদেশেও কিডনি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আশা করা যায় শিগগিরই মরণোত্তর কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হবে।

জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন
দাতা হিসেবে একজন সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তাঁর কোনো নিকটাত্মীয়, যাঁর দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, তাঁকে একটি কিডনি দান করতে পারেন। এই কিডনি সংযোজনকে জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন বা লাইফ রিলেটেড কিডনি প্রতিস্থাপন বলা হয়। আত্মীয় ছাড়া কিডনি দান করা আইন ও নীতিগতভাবে ঠিক নয় এবং এটি অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। জীবিত নিকটাত্মীয় বলতে মা-বাবা, ছেলেমেয়ে ও ভাইবোন বোঝায়। কিডনি দেওয়ার আগেই তাঁদের রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপ পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হয়। যখন দেখা যায়, কোনো আত্মীয় দাতার সঙ্গে রোগীর মিল আছে, তখন আত্মীয় কিডনিদাতার সব রকম পরীক্ষা করা হয়। কিডনিদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছর, অর্থাৎ এইজ অব কনসেন্টের ওপর বা ৬০ বছরের নিচে হতে হবে। তাঁর ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দুটো কিডনিই সম্পূর্ণ ভালো থাকতে হবে। কিডনিদাতাকে স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে হবে, জোর-জবরদস্তি করা চলবে না।

কিডনি দানে স্বাস্থ্যের তেমন সমস্যা হয় নাকিডনিদাতার পরীক্ষা করে সবকিছু নিরাপদ জেনেই তাঁর একটি কিডনি নেওয়া হয় এবং একটি কিডনি নিয়েই স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন যাপন করা যায়। ফলে একজন জীবিত সুস্থ কিডনিদাতা তাঁর একটি কিডনি দান করেও নিজে সুস্থ থাকেন এবং কিডনি-অকেজো একজন রোগী তাঁর একটি কিডনি সাফল্যজনকভাবে সংযোজন করে নিয়ে পুনরায় সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। দেখা যায়, কিডনি দান করার ফলে স্বাস্থ্যের ওপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় না বা আয়ুও কমে না। উপরন্তু কিডনি দান করার ফলে তাঁর মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ ঘটে, সম্পর্ক গভীর হয় ও আত্মীয়স্বজনের কাছে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনের প্রেক্ষাপট
বর্তমানে আমাদের দেশে শুধু লাইভ রিলেটেড কিডনি প্রতিস্থাপন বা জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজিত হচ্ছে। ১৯৮৮ সাল থেকে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) কিডনি সংযোজন শুরু হয়েছে। এখানে বছরে ২০ থেকে ২৫ জন রোগের কিডনি সংযোজন হয়। ২০০৪ সাল থেকে ইব্রাহিম মেমোরিয়াল ডায়াবেটিক হাসপাতাল বা বারডেমে কিডনি সংযোজন শুরু হয়। এখানে বছরে গড়ে ১০ থেকে ১২টা কিডনি সংযোজন হয়। ২০০৬ সাল থেকে কিডনি ফাউন্ডেশনে কিডনি সংযোজন শুরু হয়েছে। এখানে বছরে গড়ে ৪০ থেকে ৪৫টা কিডনি সংযোজিত হয়। দুই বছর ধরে কিডনি ইনস্টিটিউট অব ইউরোলজি বা নিকডুতে এবং ইউনাইটেড হাসপাতালে কিডনি সংযোজন শুরু হয়েছে। এসব হাসপাতালে শুধু লাইফ রিলেটেড কিডনি সংযোজিত হয়।

কিডনি সংযোজনের পরিসংখ্যানএ পর্যন্ত (জানুয়ারি ২০১০) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৬৫টি, কিডনি ফাউন্ডেশনে ১৪৭টি, বারডেম হাসপাতালে ৫০টি, ইউনাইটেড হাসপাতালে ২৩টি এবং নিকডুতে ১৬টি কিডনি সংযোজন হয়েছে। এর সাফল্যও সন্তোষজনক, যা উন্নত বিশ্বের সাফল্যের সমমানের দাবি রাখে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, কিডনিদাতারা সবাই ভালো আছেন ও সুস্থ জীবন যাপন করছেন। শিগগিরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কিডনি ও ইউরোলজি বিভাগের সম্প্রসারণ শুরু হবে বলে জানা গেছে। ফলে কিডনি সংযোজনসহ হেমোডায়ালাইসিস ও অন্যান্য চিকিত্সার আরও ব্যাপক বিস্তার হবে বলে আশা করা যায়। এ ছাড়া কিডনি ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে মিরপুরে বৃহদাকারে কিডনি ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ছয়তলাবিশিষ্ট স্থায়ী ভবন নির্মাণের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলেছে। আগামী জুন নাগাদ সেখানে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হবে বলে আশা করা যায়। এতে কিডনি রোগীদের চিকিত্সার প্রসার ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।

দরকার যথাযথ উদ্যোগ
বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক কিডনি সংযোজনের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে নিকটাত্মীয় কিডনিদাতার স্বল্পতা। কাজেই কিডনিদাতার স্বল্পতা কাটিয়ে উঠতে হলে ক্যাডাভারিক কিডনি প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন কিডনি রোগ সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা ও মোটিভেশন। সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক কিডনিদাতার কার্ডের প্রবর্তনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে দেশে কিডনি সংযোজনের হার আরও বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে কিডনি-অকেজো রোগীদের দেশের বাইরে কিডনি সংযোজনের জন্য যাওয়ার প্রবণতা অনেকাংশে কমে এসেছে। এখন দরকার যথাযথ উদ্যোগে ফলপ্রসূ কার্যক্রম গ্রহণ করা।

**************************
মোঃ শহীদুল ইসলাম সেলিম
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজিতে কিডনি সংযোজনে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা
অধ্যাপক, নেফ্রোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি (বিএসএমএমইউ), শাহবাগ, ঢাকা।
দৈনিক প্রথম আলো, ১০ র্মাচ ২০১০।

এইচবিএস এজি পজিটিভ যকৃতের সমস্যা :

কেস হিস্ট্রি-১

শাহজাহান শিক্ষিত বেকার যুবক। চাচাতো ভাই মহীউদ্দিন সৌদি আরবে ১০ বছর ধরে চাকরি করছেন। মহীউদ্দিনের সহযোগিতায় সৌদি আরবে চাকরির জন্য ৭০ হাজার টাকা জমা দিয়েছেন তিনি। ভিসার জন্য স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে রক্তের পরীক্ষায় এইচবিএসএজি (HBs Ag) ধরা পড়ে। এ কি নতুন কোনো রোগ? শাহজাহান এইচবিএস নেগেটিভ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। আবার রক্ত পরীক্ষা, কবিরাজের ওষুধ, পানি পড়া, তাবিজ-কবজ, আমের রস, যে যা বলছেন, তাই করছেন তিনি। কিন্তু না, এইচবিএস এজি কমছে না। হতাশ হয়ে ওঠেন এই ২৬ বছরের যুবক। ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মহাবিপদে পড়েন তিনি। কী করবেন বুঝতে পারেন না।

কেস হিস্ট্রি-২
তমাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সহপাঠীদের সঙ্গে সন্ধানীতে রক্ত দিতে গিয়ে শনাক্ত হলো এইচবিএস পজিটিভ। তাই তাঁর রক্ত অন্য কারও জন্য সংগ্রহ করা হলো না। তমাল দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। হেপাটাইটিস-বি সম্পর্কে অল্প কিছু জানেন তিনি। কীভাবে তাঁর শরীরে এ জীবাণু প্রবেশ করল? কী করবেন, কোথায় যাবেন, কার সঙ্গে পরামর্শ করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।

কেস হিস্ট্রি-৩
এহবুব সাহেবের ছোট মেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। স্কুলের হেপাটাইটিস-বি টিকা গ্রহণ কর্মসূচির আওতায় মেয়েটির রক্ত পরীক্ষায় শনাক্ত হয় এইচবিএস এজি পজিটিভ।
যে কেস হিস্ট্রিগুলো বলা হলো, তার সম্মুখীন আমরা প্রতিনিয়তই হচ্ছি। এইচবিএস পজিটিভ বলতে কী বোঝায়, কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, কী তার চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে আজকের উপস্থাপন।

এইচবিএস এজি বলতে কী বুঝায়?

এইচবিএস এজি-এর অর্থ হলো হেপাটাইটিস-বি সারফেস এন্টিজেন যা হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের দেহ থেকে নিঃসৃত হয়। শুধু হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হলেই রক্তের এইচবিএস এজি পরীক্ষা পজিটিভ হয়।
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস কী?
যেভাবে শরীরে প্রবেশ করে
হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস প্রধানত রক্ত এবং বিভিন্ন দেহাংশের মাধ্যমে ছড়ায়। যেমন :
 হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রক্ত এবং রক্তের অন্যান্য উপাদান কোনো রোগী গ্রহণ করলে।
 হেপাটাইটিস-বি আক্রান্ত রোগীর ব্যবহূত সুচ, সিরিঞ্জ, রেজার, ক্ষুর, ব্রাশ ইত্যাদি কোনো সুস্থ ব্যক্তি ব্যবহার করলে হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।
 বিভিন্ন হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, দাঁতের চিকিৎসালয়, বিউটি পার্লার, সেলুনে ব্যবহূত যন্ত্রপাতি যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার না করলে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে।
 গর্ভবতী মা যদি হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে থাকে, তাহলে জন্মের সময় নবজাতকের হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক বেশি থাকে।
 হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থাকলে।

রোগের লক্ষণ ও গতি-প্রকৃতি
অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ ছাড়াই রক্তের এইচবিএস এজি পজিটিভ পাওয়া যায়। সাধারণত বিদেশে চাকরির উদ্দেশ্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে গিয়ে, রক্তদানের উদ্দেশ্য স্ক্রিনের পরীক্ষা করতে গিয়ে বা হেপাটাইটিস-বি টিকা নেওয়ার আগে রক্ত পরীক্ষা করতে গিয়ে এইচবিএস এজি শনাক্ত হয়। কোনো উপসর্গ না থাকলেও হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস লিভারে মৃদু ইনফেকশন চালিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে লিভারের ক্ষতি করতে থাকে। তখন বলা হয় ক্রনিক হেপাটাইটিস বা দীর্ঘস্থায়ী ইনফেকশন।
পরবর্তী সময়ে লিভার সিরোসিস এমনকি লিভার ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
চিকিৎসা
এইচবিএস পজিটিভ রোগীদের প্রধান জিজ্ঞাসা এটা কীভাবে নেগেটিভ করা যায়? কত দিন লাগবে নেগেটিভ হতে? এইচবিএস এজি নেগেটিভ হয় দুভাবে—চিকিৎসার মাধ্যমে এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে। সাধারণত শতকরা ৯০ ভাগ রোগী হেপাটাইটিস-বি দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার পর (একিউট হেপাটাইটিস) সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে, বাকি শতকরা ১০ ভাগ রোগী সময়ের সঙ্গে হেপাটাইটিস-বি নেগেটিভ হয়। ক্ষেত্রবিশেষে শতকরা পাঁচ ভাগ রোগী এইচবিএস পজিটিভ মুক্ত হতে পারে না নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দ্বারা।

তাদের ক্ষেত্রে হেপাটাইটিস-বির চিকিৎসা দরকার। প্রচলিত চিকিৎসা দুই ধরনের, মুখে খাওয়ার ট্যাবলেট অথবা ইন্টারফেরন ইনজেকশন। শতকরা ৩০-৬০ জন রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার সফলতা দেখা যায়। চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসটিকে নিষ্ক্রিয় রাখে যাতে লিভারের ক্ষয়ক্ষতি কম হয় এবং ভবিষ্যতে লিভার ক্যানসার বা সিরোসিসের ঝুঁকি হ্রাস করে।

সব হেপাটাইটিস-বি রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসা এক রকম নয় এবং রোগীভেদে এর চিকিৎসার ধরন ও সময়কাল নিরূপণ করা হয়। চিকিৎসা শুরুর আগে রোগীর লিভারের কার্যকারিতা, হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসের প্রকার ও সক্রিয়তা, রোগীর শরীরের অন্যান্য ভাইরাস (যেমন হেপাটাইটিস-সি) বা অন্য রোগ আছে কি না ইত্যাদি বিবেচনায় আনতে হয়। প্রথমত রোগীর আর্থিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ চিকিৎসা ব্যয়বহুল, যদিও কিছু কিছু ওষুধ আমাদের দেশে উৎপাদিত হচ্ছে। এইচবিএস পজিটিভ রোগী যাদের চিকিৎসা শুরু করা যায় না, তাদের নিয়মিতভাবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

এ ছাড়া এইচবিএস এজি পজিটিভ রোগীর পরিবারের অন্য সদস্যদের রক্ত পরীক্ষা করে এইচবিএস এজি নেগেটিভ হলে হেপাটাইটিস-বি টিকা নিয়ে নেওয়া নিরাপদ। প্রসঙ্গত বলে রাখা দরকার, এইচবিএস এজি পজিটিভ হলে হেপাটাইটিস-বির টিকা কোনো উপকারে আসবে না।
প্রতিরোধের উপায়
আপনার সামাজিক সচেতনতাই হেপাটাইটিস-বির সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। সাবধান হতে হবে—
 সব সময় ডিসপোজেবল সুচ ও সিরিঞ্জ ব্যবহার করবেন
 অন্য কোনো ব্যক্তির রক্ত শরীরে চিকিৎসার জন্য গ্রহণ করতে হলে সঠিকভাবে পরীক্ষা করে নেবেন। পেশাদার রক্ত দাতাদের রক্ত পরিহার করে চলবেন।

 সেলুন বা বিউটি পার্লারে নাক-কান ফুটানোর ক্ষেত্রে, দাড়ি বা চুল কাটার সময় ব্যবহূত জিনিসপত্র সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে কি না খেয়াল করবেন।

 পরিবারে হেপাটাইটিস-বির রোগী থাকলে অন্যান্য সদস্যদের হেপাটাইটিস-বি ভ্যাকসিন নিতে হবে।
 দাঁতের চিকিৎসায় বা দাঁত তোলার ক্ষেত্রে যন্ত্রপাতি যথাযথ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করছে কি না জেনে নেবেন।
 ব্যক্তিগত টুথব্রাশ, রেজার, নেইল কাটার ইত্যাদি অন্যকে ব্যবহার করতে মানা করবেন।
 অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক এড়িয়ে চলতে হবে।
 হেপাটাইটিস-বি পজিটিভ মায়ের শিশুদের ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী টিকা দিয়ে নিতে হবে।

**************************
এইচ আফতাব রোজী
গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও লিভার রোগ বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ
দৈনিক প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল ২০১০।
কিডনি রোগীরা যা খাবেন না
পানি খেতে হবে পরিমিত। প্রতিদিনের পস্রাবের পরিমানের ওপর নির্ভর করবে কতটুকু পানি রোগী খেতে পারবেন।

০ কিডনি রোগী মাছমাংসদুধডিম প্রভৃতি প্রাণীজ আমিষ সীমিত পরিমাণে খাবেন। রোগীর রক্তের ক্রিয়েটিনিনশরীরের ওজনডায়ালাইসিস করেন কিনা,করলে সপ্তাহে কয়টা করেন তার ওপর নির্ভর করবে প্রতিদিন কত গ্রাম প্রোটিন খাবেন তার পরিমাণ।

০ উদ্ভিজ প্রোটিন বা দ্বিতীয় শ্রেণীর প্রোটিন যেমন-ডালমটরশুটিসিমেরবীচি যে কোন বীচি ডায়েট চার্টে থাকবে না।

০ যে সমস্ত- সবজি খাবেননা: ফুলকপিবাধাকপিগাজরঢেঁড়শশিমবরবর্টি,কাঠালের বীচিশীমের বীচিমিষ্টি কুমড়ার বীচিকচুমূলা এবং পালংপুঁইশাক ইত্যাদি।

০ ফলের ক্ষেত্রেও আছে নানান রকম নিষেধাজ্ঞা। প্রায় সব ফলেই সোডিয়াম পটাশিয়ামের আধিক্য আছে বলে কিডনি রোগীদের জন্য ফল খাওয়া একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বিশেষ করে আঙ্গুরকলা
ডাবের পানি। অল্প পরিমাণে আপেল এবং পেয়ারা তুলনামূলক নিরাপদ। 
**************************
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ মার্চ ২০১১

কিডনি রোগ:প্রতিরোধ সম্ভব

কিডনি রোগ:প্রতিরোধ সম্ভব
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কি:কিডনি যখন নিজস্ব কোন রোগে আক্রান্ত হয় অথবা অন্য কোন রোগে কিডনি আক্রান্ত হয়যার ফলে কিডনির কার্যকারিতা ৩ মাস বা ততোধিক সময় পর্যন্ত লোপ পেয়ে থাকে তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বলা হয়। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে যদি কিডনি রোগ ছাড়াও কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় তাহলেও তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বলা যেতে পারে। যেমন-ক্রনিক নেফ্রাইটিস কিডনির ফিল্টারকে আক্রমণ করে ক্রমান্বয়ে কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলতে পারে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। ঠিক তেমনি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগ না হওয়া সত্ত্বেও কিডনির ফিল্টার/ছাঁকনি ধ্বংস করতে পারে। আবার কারও যদি জন্মগতভাবে কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে অথবা কিডনির আকার ছোট বা বেশী বড় থাকে তাহলেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।

কিডনির ছাকনী: মানুষ জন্মগ্রহণ করার ৬ সপ্তাহের মধ্যেই কিডনির ছাকনি বা ফিল্টার মেমব্রেন পুরোপুরি তৈরী হয়ে যায়। অর্থাৎ কিডনি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০-১২ লক্ষ ছাকনি রয়েছে এবং প্রতি ২৪ ঘন্টায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে। এই পরিশোধিত রক্তের মধ্যে ১-৩ লিটার শরীরের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়া হয়। সুতরাং কোন কারণবশতঃ যদি এ ধরনের ফিল্টার বাঁধাপ্রাপ্ত হয় তখন দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।

কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামক জৈব পদার্থ পরিমাপ করা হয় যার মাধ্যমে কিডনি কতটুকু কাজ করছে তা বোঝা যায়। দুঃখজনক বিষয় হলো- এই জৈব পদার্থটি ৫০ শতাংশ কিডনির কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার পরেই শরীরে বাড়তে পারে। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১.৪ মিলিগ্রাম এবং মহিলা ১.৩ মিলিগ্রাম হিসেবে স্বাভাবিক ধরা হয়। যদি এই ক্রিটিনিন পুরুষের ক্ষেত্রে ১.৪ মিলিগ্রাম এর উপরে ৩ মাস বা ততধিক কাল স্থায়ী থাকে তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগী হিসাবে সনাক্ত করা হয়।

দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের জটিলতা:দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের সবচেয়ে অসুবিধা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীদের কোন উপসর্গ হয় না। ফলে বছরের পর বছর এরা চিকিৎসকের শরনাপন্ন হয় না। যখন তাদের উপসর্গ দেখা দেয় তখন তাদের কিডনির কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পায়। কিডনি কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পাওয়ার পরে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। ফলে কিডনি যখন ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে পড়ে তখন তারা মৃতু্যর কোলে ঢলে পড়ে। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ নিরূপন করা যেত তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগগুলোকে আংশিক বা পরিপূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হতো। সুতরাং কোন রোগী দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছে কিনা,এজন্য জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরী।

দরকার নিয়মিত পরীক্ষা-নিরিক্ষা:শুধুমাত্র সচেতনতার মাধ্যমেই একজন রোগীর কিডনি রোগ আছে কিনা তা জানা সম্ভব। যেমন: যে কোন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা,প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কিনা তা জানা এবং ডায়াবেটিস আছে কিনা তা নিরূপন করা প্রয়োজন। যদি কারো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অথবা ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন তাকে অন্ততঃ বছরে ১ বার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন এবং মাইক্রো অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিনা এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক কিনা তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।

কিডনি রোগের ভয়াবহতা:বেশীর ভাগ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের কোন উপসর্গ হয় না। তাই তারা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয় না। সুতরাং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সমন্ধে সকলের ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদিও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে বমি বমি ভাবক্ষুধা-মন্দারক্ত সল্পতাশরীরে পানি জমাশ্বাস কষ্ট এবং প্রস্রাবের পরিমাণের তারতম্যচর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন কার্যকারিতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। আমাদের দেশে শতকরা ৮০ ভাগ কিডনি রোগী এই উপসর্গগুলো নিয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় এবং রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় যেকিডনির ৮০ ভাগ কার্যকারিতাই তখন নষ্ট হয়ে গেছে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো হওয়ার ফলে উপরিউক্ত উপসর্গ ছাড়াও শরীরে অনেক জটিলতা দেখা দেয়। যার মধ্যে প্রধান হলো হূৎপিন্ডের রোগ।

দেশে ১ কোটি ৮০ লাখ কিডনি রোগী: বাংলাদেশে কিডনি ফাউন্ডেশন এবং বিএসএমএমইউ-র উদ্যোগে সাভারের চাকুলিয়া গ্রামে বিগত ৩ বছর ধরে কতজনের দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ রয়েছে তার উপর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ৩ হাজার প্রাপ্ত বয়স্ক লোকের উপর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যেপ্রায় শতকরা ১৮ ভাগ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে শতকরা ১৩ ভাগ রোগীর রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে উপরে অথর্াৎ তাদের কিডনির কার্যকারিতা ক্রমান্বেয়ে হ্রাস পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে ১৫,৬২৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপর সমীক্ষায় দেখা যায় যেএদের ১১ ভাগ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। অস্ট্রেলিয়ায় এই সংখ্যা ১৬% এবং আইসল্যান্ড ১০%। এই সমীক্ষা থেকে এটা প্রতিয়মান হয় যেবর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ লোক দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে ভুগছে।

প্রতিবছর মারা যায় ৪০ হাজার:বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকে এটা ধারণা করা হয়-বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগীর কিডনি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে মারা যায়। এই উধর্্বহারে কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ হিসাবে নেফ্রাট্রিসডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। নেফ্রাইটিস রোগের প্রধান কারণ হিসাবে বিবেচিত হওয়ার জন্য ব্যাকটেরিয়া জনিত ইনফেকশনভাইরাল হেপাটাইটিসযহ্মাম্যালেরিয়াকালা-জ্বর এবং ওষুধের পাশর্্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ মিশানো এবং ভেজালক্রনিক ইন্টারস্টেশিয়াল নেফ্রাইটিস এর কারণ হিসাবে দায়ী করা যেতে পারে। এমনকি পানিতে অধিক পরিমানে আর্সেনিক কিডনি রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। মার্কারিলেডগোল্ড এবং অন্যান্য ধাতব পদার্থ কিডনি রোগের কারণ হতে পারে। হেপাটাইটিস 'বিএবং'সিভাইরাস এইচআইভি ভাইরাস দক্ষিণ আফ্রিকাতে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের একটি বড় কারণ। ঠিক তেমনি ম্যালেরিয়া আফ্রিকা মহাদেশে কিডনি রোগের কারণ হিসাবে বিবেচিত।

কিডনি অকেজো রোগীর চিকিৎসা:কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে শুধু ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন। বর্তমান বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী ৫ থেকে ১৫ বছর এবং সফল কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীতে নিয়মিত হেমোডায়ালাইসিসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত রোগী বেঁচে আছে এবং সফল কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৩ বছর বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। (নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে ৩ বার ৪ ঘন্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা বুঝায়।) ঠিক তেমনি নিকট আত্মীয়ের কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপনকে কিডনি সংযোজন বোঝায়। অবশ্য উন্নত বিশ্বে মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে।

কিডনি রোগ সনাক্ত করা দরকার:বর্তমানে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ কিভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব তা নিয়ে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। গ্রাম ও শহর পর্যায়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ সনাক্ত করে তা চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ের চলমান গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যেদীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৮% যাদের মধ্যে ১৮.৫% এরই উচ্চ রক্তচাপ৫% ডায়াবেটিস এবং ৬% প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয়। এই ৫% ডায়াবেটিস রোগীর ৩০ শতাংশ এবং ১৮% উচ্চ রক্তচাপের ১৫% এবং ৬% রোগীর যাদের প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় সবাই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। উক্ত সমীক্ষায় রোগীদের প্রশ্ন রাখা হয়েছিল তারা ডায়াবেটিসউচ্চরক্তচাপ এবং প্রস্রাব প্রোটিন নির্গত হওয়া সম্পর্কে জানেন কি না। শতকরা ৬০% রোগী জানেই না যে তাদের ডায়াবেটিস উচ্চ রক্তচাপ অথবা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়নি। সুতরাং এই রোগীগুলোই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে ভুগে ক্রমান্বয়ে সম্পূর্ণভাবে কিডনি বিনষ্ট হয়। এই রোগীগুলোকেই সনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত।

কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়:এটা পরীক্ষিত যেএসিই-ইনহেবিটরস এবং এআরবি জাতীয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিডনি রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। ঠিক তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা মাইক্রো-অ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়ামফাস্টফুড না খাওয়াচর্বি জাতীয় খাবারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এছারাও ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেলেধুমপান না করলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হূদরোগ থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।

কিডনি রোগীদের সচেতন করে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ সনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে লক্ষ লক্ষ কিডনি রোগীর কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কিডনি অকোজো রোগীরা ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের বিশাল খরচ থেকে মুক্তি পাবে।


**************************
অধ্যাপক হারুন আর রশিদ
সভাপতিকিডনি ফাউন্ডেশন ও
বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন
দৈনিক ইত্তেফাক, ১২ মার্চ ২০১১


ভিটামিন ডি-এর গুণ

ভিটামিন ডি-এর গুণ
ভিটামিন ডি হাড়ের জন্য ভালো। শুধু ভালো নাবলতে হবে অত্যাবশ্যকীয়। সুস্থ দাঁতের জন্যও দরকার ভিটামিন ডি। এটুকু আমরা সবাই জানি। তবে আমেরিকার একডেমী অফ ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান্স সম্প্রতি জানিয়েছে নতুন এক তথ্য। ভিটামিন ডি শুধু হাড় ও দাঁতের গঠনেই কাজে লাগেনা এটি ডায়াবেটিস হূদরোগ এবং ক্যান্সার প্রতিরোধেও সাহায্য করে। সুতরাং নিজের খাদ্য তালিকাটি আবার পরখ করে দেখুন পর্যাপ্ত ভিটামিন পাচ্ছেন তো?

**************************
ডাঃ গুলজার হোসেন উজ্জল
দৈনিক ইত্তেফাক, ০৫ মার্চ ২০১১